ফাতেমা জান্নাতুল ফেরদৌস সুরভী: কখনো কখনো একটি চিত্রকর্ম ভাষার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। যখন কোনো চিত্রকর্ম কথা বলে কিংবা বিশেষ কোনো কাজে ব্যবহৃত হয়, তখন সেটি আর চিত্রকর্ম থাকে না, সেটি হয়ে যায় ‘শিল্প’। সুতায় বোনা এমনি একটি শিল্প হলো ‘শতরঞ্জি’। ‘শতরঞ্জ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ দাবাখেলা। ধারণা করা হয়, দাবাখেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশার মিল থাকায় ‘শতরঞ্জি’ নামকরণ হয়েছে। আবার অনেকের মতে, বিভিন্ন রঙের ব্যবহারের সূত্র থেকেই এর নামকরণ হয়েছে শতরঞ্জি। ‘শতরঞ্জি’ রংপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি নাম। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে ঐতিহ্যবাহী ঘাঘট নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল এক ছোট্ট গ্রাম পীরপুর। পীরপুর ছিল হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস ঐতিহ্যের এক উর্বরভূমি। বছরের পর বছর ধরে পীরপুরের সাধারণ মানুষের হাতের নিপুন ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছে শতরঞ্জি নামের এই হস্তশিল্প। মুঘল আমলে শুরু হওয়া এই শতরঞ্জির বয়স এখন সাতশত বছর। সময়ের আবর্তনে পরিবর্তন হয়েছে তার নকশায় ও ব্যবহারে।
১৮৩০ সালের কথা। তৎকালীন রংপুরের কালেক্টর মিস্টার নিসবেত এই শতরঞ্জির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এর প্রচারে ও প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শতরঞ্জির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় মিস্টার নিসবেতের নাম অনুসারে পীরপুর গ্রামের নামকরণ হয় নিসবেতগঞ্জ। নিসবেতগঞ্জের শতরঞ্জি এখন বিশ্বদরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে শতরঞ্জি বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানিযোগ্য হস্তশিল্প। শুধু তাই নয়, দেশের সপ্তম জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে রংপুরের এই প্রাচীন ঐতিহ্য। জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক হলো মেধা সম্পত্তি অধিকারের একটি কাঠামো, যা একটি পণ্যকে কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থানের স্বাতন্ত্র্য পণ্য হিসাবে চিহ্নিত করে। কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মেধাসত্ত্ব বিষয়ক সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন) এই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) শতরঞ্জির জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে। একই বছরের ১১ই জুলাই আন্তর্জাতিক মেধাসত্ত্ব বিষয়ক সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন) শতরঞ্জিকে জিআই পণ্যের মর্যাদা দেয় এবং ২০২১ সালের ১৭ই জুন সনদ হস্তান্তর করে। কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। এ ছাড়া রংপুর জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসাবেও শতরঞ্জিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
মোঘল আমল থেকে তৎকালীন রাজা-বাদশাহ-জমিদারদের অন্দরমহলে শতরঞ্জি শোভা পেতো আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে। ব্রিটিশ শাসনামলে রংপুরের শতরঞ্জি সমগ্র উপমহাদেশের পাশাপাশি রপ্তানি হয়েছে বার্মা, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে এটি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩৬ টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বিশ্বের প্রাচীনতম বুননশিল্পের মধ্যে শতরঞ্জি অন্যতম। প্রাচীন আমলে গ্রামে মোটা ডোরাকাটা রং-বেরংয়ের সুতার গালিচা বা শতরঞ্জি তৈরি হতো। সময়ের বিবর্তনে তাতে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। এ পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার হয় না কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে বাঁশ ও রশি দিয়ে মাটিতে সুতা বিছিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় এক-একটি নকশা। শিল্পীরা প্রতিটি সুতা গণনা করে হাত দিয়ে বাঁধাই করে কোনো জোড়া ছাড়াই নিপুনভাবে গড়ে তোলেন তাদের এই অনিদ্য সুন্দর শিল্পকর্মকে। শতরঞ্জি তৈরিতে সাধারণত প্রাচীন ও আধুনিক দুই ধরনের মোটিফ ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন নকশাগুলোর মাঝে ফুটে উঠতো নাটাই, ইটকাঠি, পালকি, ফুল-পাতা, পৌষপার্বণ, নবান্ন ও গ্রাম বাংলার জীবনযাত্রার নানান রূপ। বর্তমানে সেগুলোর পাশাপাশি মাছ, নৌকা, মিনার-সহ বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক আকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। সুতার ধরনেও রয়েছে বৈচিত্র্য। সাধারণত লাল, নীল, কালো, হলুদ, সাদা, বেগুনি ও সবুজ রঙের প্রাধান্য দেখা গেলেও আরও বিভিন্ন রঙের কারসাজি দেখতে পাওয়া যায় শতরঞ্জির প্রতিটি বুননে। শতরঞ্জির সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো, এটি উভয়দিকে ব্যবহারযোগ্য এবং সহজেই সাধারণভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলা যায়।
শিল্পায়নের যুগে আধুনিক মেশিনে প্রস্তুত পণ্যের ভিড়ে হাতে তৈরি শতরঞ্জি বাজারে তুমুল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া আর্থিক সীমাবদ্ধতা, স্বল্প মজুরি, বিপণনে সঠিক পরিকল্পনার অভাব কারিগরদের পেশা পরিবর্তনের দিকে উদ্বুদ্ধ করছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ইদানীং মানুষ নিজের এক টুকরো শান্তির নীড় সাজাতে ক্রমেই শতরঞ্জি ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। শতরঞ্জি বর্তমানে শুধু বিলাসিতাই নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মাঝে জায়গা করে নিচ্ছে। শুধু ঘরের মেঝেই নয়, ব্যাগ, ছোটো পার্স, টেবিল ম্যাট, জায়নামাজ, ওয়ালমেট-সহ আরও বেশ কিছু সৃজনশীল পণ্যে শতরঞ্জির ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে।
শতরঞ্জির উৎপাদন বৃদ্ধিতে রংপুরে বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করছে। শতরঞ্জির বিপণনে প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ই-কমার্স ও এফ-কমার্সসহ অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমে শতরঞ্জি বিক্রি হচ্ছে। এর ফলে অনেক নতুন উদ্যোক্তার কর্মসংস্থান হয়েছে।
কালের বিবর্তনে বাংলার অনেক শিল্প হারিয়ে গেলেও রংপুরের শতরঞ্জি এখনও স্বগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শতরঞ্জি আজ শুধু রংপুরের গর্ব নয়, পুরো দেশের গর্ব। সেই নিসবেতগঞ্জের ছোট্ট পরিসর থেকে বেরিয়ে শতরঞ্জি এখন বিশ্বের বাজারে স্থান করে নিয়েছে। শতরঞ্জিকে ব্যাপক পরিসরে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
লেখক : তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর
সবশেষ খবর এবং আপডেট জানার জন্য চোখ রাখুন বাংলাদেশ গ্লোবাল ডট কম-এ। ব্রেকিং নিউজ এবং দিনের আলোচিত সংবাদ জানতে লগ ইন করুন: www.bangladeshglobal.com