ঢাকা      রবিবার, ০৪ জুন ২০২৩, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
শিরোনাম

জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত প্রস্তাবসমূহ বৈশ্বিক সংকট নিরসনে পথ দেখাবে বিশ্বকে

IMG
22 October 2022, 2:46 PM

মোতাহার হোসেনঃ নিইউয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সময়োপযোগী,বাস্তবমুখী এবং বিশ্ব নেতাদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যা,রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবন্ধ,কতিপয় দেশের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট থেকে পরিত্রাণে তাঁর সুনির্দ্দিষ্ট প্রস্তবনা বিশ্ব নেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। পাশাপাশি মিয়ামনারের সামরিক জান্তা কর্তৃক নির্যাতন ,নীপিড়নের স্বীকার বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন সম্পির্কৃত প্রস্তাবসমূহ তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত পাঁচ প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে,রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়াকে সমর্থন করাসহ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং জাতীয় আদালতের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তা করা। তৃতীয় প্রস্তাব, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। চতুর্থটি হচ্ছে, আসিয়ানের পাঁচ-দফা ঐক্যমত মেনে চলার অঙ্গীকার পূরণে মিয়ানমারকে দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানানো। সর্বশেষ প্রস্তাব হচ্ছে, মিয়ানমার যাতে বাধাহীন মানবিক প্রবেশাধিকারে রাজি হয় সেজন্য উদ্যোগ নেয়া। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত মাসে আমরা দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকটের ষষ্ঠ বছরে পা দিয়েছি। তাদের (রোহিঙ্গা) একজনকেও তাদের ঘরে ফিরতে দেখিনি।’ এ সময় মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাসে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।, ‘আরাকানে, বর্তমানে যা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য হিসেবে পরিচিত, অষ্টম শতক থেকেই রোহিঙ্গারা বসবাস করে আসছে।’ বাংলাদেশ আশা করছে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের আশু হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা দ্রুত নিজ দেশে ফিরে যাবে।

উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ১২ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়া এবং প্রতিবছর শরণার্থী শিবিরে ৩০ হাজার নবজাতকের জন্ম নেয়ার তথ্যও বাংলাদেশ উপস্থাপন করে। ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয়ভাবে তাদের শক্তিশালী মানবিক ও রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ। নিজ দেশে ভালো এবং নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষায় থাকার এই সময়ে রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সংহতি প্রয়োজন বলে মনে করে বাংলাদেশ’

প্রসঙ্গত: ২০১৭ সালে স্বদেশ থেকে বাস্তুচ্যূত হয়ে তাদের গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে গত আগস্টে।’ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তচ্যূত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দুরূহ করে তুলেছে। বাংলাদেশ আশা করে, এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

‘আমরা দারিদ্র্যমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন, সংঘাত প্রতিরোধ এবং আর্থিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কটের মতো বৈশ্বিক প্রতিকুলতাগুলোর রূপান্তরমূলক সমাধান খুঁজতে আগ্রহী। তবে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ব্যতিত আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান এবং নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সকল মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসংকটে পতিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে, শিশুরাই বেশি কষ্ট ভোগ করে। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যায়। বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন, ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন বন্ধ করুন। শিশুকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা দিন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।’ বাংলাদেশ দেখতে চায়, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব- যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐকবদ্ধ প্রচেষ্টা।’ ‘একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরও সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।’

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করে। দুই লাখ মাবোনের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। একাত্তরে যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-ক্যু-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে বাংলাদেশের জনান তা জানে।, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে হবে।’ সমুন্নত রাখতে হবে মানবিক মূল্যবোধ। সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরির পথে এগিয়ে যেতে হবে।
শেখ হাসিনার ভাষণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, কোভিড-১৯ মহামারি, ফিলিস্তিন এবং অভিবাসন বিষয়ক বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতের অবসানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যুদ্ধ বা একতরফা জবরদস্তিমূলক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মতো বৈরীপন্থা কখনও কোনো জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনাই সঙ্কট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়। তাই, ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান হওয়া দরকার। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেওয়া হয়। তাই, বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) বন্ধ করুন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।,‘বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরীতা নয়”। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিপাদ্য-উদ্ভূত জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে আসছে।

এদিকে, জাতিসংঘে প্রদত্ত বৈশ্বিক সংকট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম প্রস্তাবে বলেন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বৈশ্বিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা করতে হবে। জি-৭, জি-২০, ওইসিডি, আইএফআই ও এমডিবিকে এখন তাৎক্ষণিক উদ্বেগগুলো মোকাবিলার প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে এসডিজি অর্থায়নের অভাব, সীমিত আর্থিক সংস্থান, ক্রমহ্রাসমান ওডিএ এবং ঋণ পরিসেবা। দ্বিতীয় প্রস্তাব , আমরা সংঘাতের সময় খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থাকে ক্ষতির হাত থেকে দূরে রাখার জন্য ভবিষ্যতের যে কোনো উদ্যোগকে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তৃতীয় প্রস্তাব, বিশ্ববাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সাহসী ও ব্যাপক পদক্ষেপের প্রয়োজন। বিশ্ববাণিজ্য ও রপ্তানি আয়ে নিম্নও মধ্যমআয়ের দেশগুলোর ন্যায্য অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা অপরিহার্য। প্রধানমন্ত্রী তার চতুর্থ প্রস্তাব, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং কার্যকর খাদ্য সংরক্ষণ ও বিতরণব্যবস্থার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি করতে প্রযুক্তি সহায়তা, বর্ধিত ওডিএ এবং রেয়াতি অর্থায়নের লক্ষ্যে আমাদের আরও জিটুজি ও বিটুবি সহযোগিতার প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর পঞ্চম প্রস্তাব, জলবায়ু সহযোগিতার জন্য বৈশ্বিক কাঠামোকে আরও কার্যকর ও ন্যায্য করতে হবে। আর শেষ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসন্ন কপ ২৭-এর সুযোগটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর উদ্বেগ নিরসনে কাজে লাগানো উচিত। প্রত্যাশা জাতিসংঘে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে উত্থাপিত প্রস্তাব,পরামর্শ স্থানীয়,আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংকট নিরসনে সহায়ক হবে।

লেখক: সাংবাদিক,সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

সবশেষ খবর এবং আপডেট জানার জন্য চোখ রাখুন বাংলাদেশ গ্লোবাল ডট কম-এ। ব্রেকিং নিউজ এবং দিনের আলোচিত সংবাদ জানতে লগ ইন করুন: www.bangladeshglobal.com

সর্বশেষ খবর

আরো পড়ুন