নাসরীন মুস্তাফা: প্রাচীন পৃথিবীতে ডায়নোসরদের রাজত্ব চলছিল। একদিন এক উল্কা এসে আঘাত হানল পৃথিবীতে। বিষাক্ত গ্যাসের কারণে অক্কা পেল সবাই। এরকম কিছু হতে পারে, ডায়নোসরদের ভাবনায় ছিল না। এরকম কিছু হলে বাঁচার জন্য কী করা দরকার, সেসব ভাবার মতো বুদ্ধিও ছিল না ওদের। আর তাই, সব শেষে মারা পড়ল যে মা ডায়নোসর, সে তার বাচ্চাকে হয়তো এটুকুই কেবল বলতে পেরেছিল, বাছা! চল, আমরা একটা মজার খেলা খেলি। বাচ্চাটা ভেবেছিল, মজার খেলা মানে ইয়া জোরে লাফ দেওয়া। মা এর চেয়েও মজার খেলার লোভ দেখায়। লাফ দেওয়ার চেয়েও মজার খেলা। বাচ্চাটা খুব খুশি। বলে, আমি খেলব। মা! বল বল, আমাকে কী করতে হবে? তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে। মা বলেছিল। বাচ্চাটা এসেছিল। হুপ্ হুপ্ করে লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছিল। মা আরও কাছে আসতে বললে বাচ্চাটা এসেছিল আরও কাছে। একেবারে মায়ের বুকের মাঝে। মায়ের কথায় মা’কে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। মায়ের বুকে মাথা রাখল। কান পাতল বুকে। ভেবেছিল, আসলেই বুঝি এ এক মজার খেলা। নতুন খেলা তো বটেই। মায়ের বুকের ভেতর যে আওয়াজটা হচ্ছিল, তা কিন্তু হুপ্ ছিল না। ছিল ঢিপ ঢিপ। ঢিপ ঢিপ। মায়ের কথায় বাচ্চাটা বুকে কান রেখে চোখ বুজে। তারপর গুনতে থাকে। এক দুই তিন... মা বলেছিল, না সোনা। উল্টো দিক থেকে গুনতে হবে যে! এই যে এরকম, দশ, নয়, আট...সাত, ছয়, পাঁচ...
দুই হাত দিয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরেছিল মা ডায়নোসরটা। বাচ্চাটাকে চোখ বুঁজে রাখা গেছে বলে বাঁচা। নইলে আকাশ থেকে ছুটে আসা আগুনের গোলাটা ওকে দেখতে হতো । কী ভয়ই না পেত বাচ্চাটা! শেষ ডায়নোসর মা এই শান্তি নিয়ে মরেছিল যে তার বাচ্চাটা ভয় নিয়ে মরেনি। খেলতে খেলতে, খেলার মজা পেতে পেতে মরেছিল। কাল্পনিক গল্পটাতে ডায়নোসর মা আর বাচ্চার পরিবর্তে মানুষ মা আর বাচ্চাকে বসিয়ে ভাবলে কেমন হয়? ভেবে নেই, সব শেষে মারা পড়ল যে মা, সে তার বাচ্চাকে হয়তো এটুকুই কেবল বলতে পেরেছিল, বাছা! চল, আমরা একটা মজার খেলা খেলি। বাচ্চাটা খুব খুশি। বলে, আমি খেলব। মা! বল বল, আমাকে কী করতে হবে?
তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে। মা বলেছিল। বাচ্চাটা ছুটে এসেছিল। মা আরও কাছে আসতে বললে বাচ্চাটা এসেছিল আরও কাছে। একেবারে মায়ের বুকের মাঝে। মায়ের কথায় মা’কে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। মায়ের বুকে মাথা রাখল। কান পাতল বুকে। ভেবেছিল, আসলেই বুঝি এ এক মজার খেলা। নতুন খেলা তো বটেই। মায়ের বুকের ভেতর খুব আওয়াজটা হচ্ছিল, ঢিপ ঢিপ। ঢিপ ঢিপ। মায়ের কথায় বাচ্চাটা বুকে কান রেখে চোখ বুজে। তারপর গুনতে থাকে। এক দুই তিন... মা বলেছিল, না সোনা। উল্টো দিক থেকে গুনতে হবে যে! এই যে এরকম, দশ, নয়, আট... সাত, ছয়, পাঁচ... দুই হাত দিয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরেছিল মা। বাচ্চাটাকে চোখ বুঁজে রাখা গেছে বলে বাঁচা। নইলে আকাশ থেকে ছুটে আসা আগুনের গোলাটা ওকে দেখতে হতো। কী ভয়ই না পেত বাচ্চাটা! শেষ মানুষ মা এই শান্তি নিয়ে মরেছিল যে তার বাচ্চাটা ভয় নিয়ে মরেনি। খেলতে খেলতে, খেলার মজা পেতে পেতে মরেছিল। এভাবে কেনো ভাবছি?
ইউক্রেনের আকাশ থেকে ছুটে আসা রাশিয়ার বোমা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল যে বাড়িটা, সে বাড়িতে একটি শিশুর জন্মদিনের উৎসব ছিল। চুলায় বসানো ছিল মায়ের বানানো কেক। ধ্বংসস্তূপের ভেতর মা’কে জড়িয়ে ধরা বাচ্চাটা এই আনন্দ নিয়ে মরেছিল, একটু পরেই কেক কাটা হবে, সবাই ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে। আশ্চর্যজনকভাবে টিকে গেল চুলাটা, ভেতরে কেক হচ্ছে। চুলা নেভানোর জন্য কেউ বেঁচে নেই। কাজেই কেকটা পুড়ে ছাই হবে। এও ভালো এক দিক থেকে। খাওয়ার জন্য কে-ই বা বেঁচে ছিল সেখানে! ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ দীর্ঘ কাল চলার নাটক চলমান।
তাইওয়ানকে নিয়ে চীনও যেন যুদ্ধবাজ হয়ে ওঠে, সে প্রলোভনও তীব্র হচ্ছে। চীনা বোমাও যদি উড়ে আসে, চুলায় কেক বা পিঠা যে মা-ই বসান না কেনো, পরিণতি ছাই-ই হবে। আমরা গলির দোকানে আজ তেল, কাল পেঁয়াজ, পরশু ডিমের দাম নিয়ে মাথা গরম করছি আর শুনছি, এসবই যুদ্ধের ফল। ডলার-রুবলের ওঠাপড়া, রেমিটেন্স কাকে বলে ও কত প্রকার, এসব নিয়ে খাঁটি অর্থনীতিবিদদের মতো আলাপ করতে করতে বিলাপ করছি যুদ্ধ যুদ্ধ বলে। বিশ্ব এখন স্রেফ একটি মহল্লার আকার নিয়েছে। কাজেই, যে যুদ্ধ লাগাক না কেনো, আমাদের পাতের খাবারে এর প্রভাব দেখতেই হবে। কে জিতবে, তা নিয়ে বোদ্ধাদের আলাপ জমতে পারে, আমাদের পিঠে যে পরাজয়ের বোঝা চাপবেই, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যুদ্ধের কোনো পক্ষ না হয়েই পরাজয়ের বোঝা পিঠে নিতে হবে! এই অন্যায়ের বিচার সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইতে গেলে টের পাবেন, সে দপ্তরও আপাতত ওভারলোডেড!
এই অবস্থায় সাবধান হওয়া ছাড়া আপাতত আমাদের উপায় নেই। নিজের খাবারটা নিজেই যদি তৈরি করতে পারি, বিলাসিতা বাদ দিয়ে স্রেফ যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু দিয়ে ন্যূনতম পক্ষে বেঁচে থাকার শক্তি পাই, তাহলে বেঁচে গেলাম। সাদামাটাভাবে এরকম কৌশলই বাতলে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নেতা হিসেবে তাঁর জনগণকে ভবিষ্যতের দুরবস্থা সম্পর্কে সাবধান করতে চেয়েছেন সম্প্রতি। বলেছেন, আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আমাদেরকে খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হবে। আমাদেরকে কৃচ্ছতা সাধন করতে হবে। কোনোভাবেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। বরঞ্চ প্রয়োজনের লাগাম টেনে ধরতে হবে, মিতব্যয়ী হতে হবে। কেনো? তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ আসছে।
বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বণি শুনতে পেয়ে দেশগুলো যে যার মতো প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ একটু কমতে না কমতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয় দেশগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি সরবরাহে ভাটার টান পড়েছে বলে তারা রেশনিং করছে। শীতের দেশে পানি গরম করা, ঘর গরম করা জরুরি হলেও সীমিত করা হয়েছে হিটিং সিস্টেম ব্যবহার। এর ফলে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যার ধাক্কা এসে লেগেছে আমাদের মতো দেশগুলোতেও। আমাদেরকেও প্রস্তুতি নিতে হবে। ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, দুর্ভিক্ষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে আমরা কি বাঁচতে পারব? বাঁচার জন্য সব রকম উপায়েই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে হবে। কম খেয়ে বাঁচা যায়, একদম না খেয়ে মরতে চায় কে?
রাষ্ট্র দুর্নীতি রোধ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে, অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ করবে না এবং চলমান প্রকল্প যত দ্রু ত সম্ভব শেষ করবে, এই দাবী জনগণের। আবার রাষ্ট্র সব করে দেবে, এমন ভাবনা নিয়ে চুপ করে বসে থাকলে ব্যক্তি পর্যায়ে বিপদ ঠেকানো সম্ভব হবে না। আমার জন্য আমাকে সাবধান হতে হবে। আপনার জন্য সাবধান হবেন আপনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা স্পষ্ট করে বলেছেন, আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরকেই করতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে সাবধানতার কিছু কৌশল তিনি বলেছেন। যেমন- এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, ততটুকু উৎপাদন করতে হবে। ছাদবাগানকে উৎসাহিত করে তিনি বলেছেন, সেখানে যদি কিছু উৎপাদন করা যায়, তাহলে বাজারের ওপর চাপ কম পড়বে। সৃষ্টিকর্তা নিজেও বলেছেন, আমার উপর ভরসা রেখো কিন্তু উটের গলায় দড়ি পরিয়ে রাখতে ভুলো না। অন্য দেশ বা ব্যক্তি আমাদেরকে বাঁচাতে আসবে, এই ধারণা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমরা বরং আমাদের উটের গলায় দড়ি পরিয়ে রাখি। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। এবং আমরা যে পাগল নই, প্রমাণ দিতে হবে আমাদেরকেই।
বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং সাবধান করে বলেছিলেন, এই একুশ শতকই নাকি মানুষের শেষ শতক। মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই শতকেই। মানুষ বিলুপ্ত হবে মানুষেরই কারণে। পারমানবিক বোমার সুইচ টেপার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে উস্কানি পক্ষ সক্রিয় বলে ভয়টা তীব্র। সেই ভয় নিয়েই বলি, বাঁচতে হলে সাবধান হতে হবে। আমাদের সাবধানতা হয়তো বিশ্বের অন্য দেশকে পথ দেখাবে, যুদ্ধবাজ পরাশক্তিদের মাঝে বোধোদয় সৃষ্টি করবে...হয়তো! এটুকু আশা করতে চাই। কেননা, আশা না করলে বাঁচার সাহসটা কমে যায় যে!
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার
সবশেষ খবর এবং আপডেট জানার জন্য চোখ রাখুন বাংলাদেশ গ্লোবাল ডট কম-এ। ব্রেকিং নিউজ এবং দিনের আলোচিত সংবাদ জানতে লগ ইন করুন: www.bangladeshglobal.com