ঢাকা      শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১
শিরোনাম

উত্তর প্রদেশে ‘মোদি ঝড়’ রুখে দিলো অখিলেশ-রাহুলের জুটি

IMG
05 June 2024, 6:14 AM

ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক, বাংলাদেশ গ্লোবাল: আশি বনাম বিশের লড়াই। দুই বছর আগে বিধানসভা ভোটে উত্তর প্রদেশে হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতের স্লোগান দিয়ে মেরুকরণের তাস খেলে বাজিমাত করেছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। এবারের লোকসভা নির্বাচনে জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের বৃহত্তম অঙ্গরাজ্যে হিন্দুত্বের আবেগ উস্কে দিতে বিজেপির মূল অস্ত্র ছিল, নব্বইয়ের দশকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া বাবরি মসজিদের জমিতে গড়ে তোলা রাম মন্দির। ভোটের ফল বলছে রাম মন্দিরের রাজ্যেই ‘মোদি ঝড়’ রুখে দিয়েছেন সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-র প্রধান অখিলেশ যাদব এবং তাঁর সহযোগী কংগ্রেস।

উত্তর প্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৩৭টিতে জিতে একক বৃহত্তম দল হয়েছে এসপি। সহযোগী কংগ্রেস জিতেছে ছয়টিতে। অন্যদিকে, যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে নরেন্দ্র মোদির দল জিতেছে ৩৩টি লোকসভা আসনে। সহযোগী আরএলডি (রাষ্ট্রীয় লোকদল) দু’টি, আপনা দল (এস) একটিতে। নাগিনা আসনে একক শক্তিতে লড়ে জিতেছেন দলিত সংগঠন ভীম আর্মির প্রধান তথা আজাদ সমাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর আজাদ ওরফে রাবণ।

বারাণসীতে ২০১৪ সালে ৩ লাখ ৭১ হাজার এবং ২০১৯ সালে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জেতা মোদি এনার ১ লাখ ৫২ হাজার ভোটে হারিয়েছেন কংগ্রেসের অজয় রাইকে। অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী রায়বেরেলিতে প্রথমবার লড়ে জিতেছেন প্রায় ৪ লাখ ভোটে!

ভারতের সংসদীয় রাজনীতির অঙ্ক বলছে, দিল্লি দখলের পথ একটাই— ভায়া লখনউ। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রধানমন্ত্রী উপহার দিয়েছে এই রাজ্যই। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, চৌধুরী চরণ সিংহ, রাজীব গান্ধী, ভিপি সিংহ, চন্দ্রশেখর— সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। অটল বিহারী বাজপেয়ী লখনউ থেকে জিতেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

এক দশক আগে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদে পৌঁছে দিতেও এই রাজ্যের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। সেবার বারাণসীর পাশাপাশি গুজরাটের বরোদা থেকে জিতলেও পরবর্তী সময়ে উত্তর প্রদেশের তীর্থনগরীকেই বেছে নিয়েছিলেন মোদি। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি।

২০১৪-য় দেশজুড়ে পদ্ম ঝড়ে উত্তর প্রদেশ কার্যত বিরোধী শূন্য হয়ে গিয়েছিল। ৮০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩টিতেই জিতেছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। তার মধ্যে বিজেপি একাই ৭১টিতে। সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৫টি এবং কংগ্রেস ২টি আসনে জিতেছিল। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর দলের হাল হয়েছিল বাংলায় নীলবাড়ির লড়াইয়ে বাম-কংগ্রেসের মতো— শূন্য!

২০১৯-এ অবশ্য বিজেপিকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল অখিলেশ যাদব এবং মায়াবতীর জোট। উত্তর প্রদেশের দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শত্রুতার প্রাচীর ভেঙে ‘বুয়া-বাবুয়া’ রূপে অবতীর্ণ হয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ১৫টি আসন। পুলওয়ামা সন্ত্রাস এবং তার ‘জবাবে’ পাকিস্তানের বালাকোটে জঙ্গি শিবিরে ভারতীয় বায়ুসেনার অভিযান ঘিরে হিন্দি বলয়ের অন্যত্র বিজেপি অনায়াসে জিতলেও আংশিক ব্যতিক্রম ছিল উত্তর প্রদেশ। এসপি-বিএসপির জোট অবশ্য তার কয়েক মাস পরেই ভেঙে গিয়েছিল।

২০১৯-এর ভোটে উত্তর প্রদেশে একা লড়ে ধরাশায়ী হয়েছিল কংগ্রেস। ৬ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিল একমাত্র রায়বেরেলিতে। সোনিয়া গান্ধীর আসনে। কিন্তু আমেথির ‘গান্ধী গড়ে’ বিজেপির স্মৃতি ইরানির কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন রাহুল গান্ধী।

‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে যাওয়া সেই কংগ্রেসের সঙ্গেই এবার সমঝোতা করেছিলেন অখিলেশ। ৮০টি আসনের মধ্যে ৬২টিতে প্রার্থী দিয়ে ১৭টি ছেড়েছিলেন রাহুল-মল্লিকার্জুন খাড়গের দলকে। অবশিষ্ট আসনটি (পূর্ব উত্তর প্রদেশের ভদোহী) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূলকে।

নরেন্দ্র মোদি ভদোহীতে প্রচারে গিয়ে যা নিয়ে খোঁচা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘বাবুয়া এবার উত্তর প্রদেশের বুয়ার (মায়াবতী) সঙ্গ ছেড়ে বাংলার বুয়া (মমতা)-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।’’ ভদোহীতে মমতার দল প্রার্থী করেছিল সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কমলাপতি ত্রিপাঠীর পৌত্র ললিতেশপতিকে। কিন্তু ৪৪ হাজার ভোটে হেরেছেন তিনি।

জোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে ছিল না বিজেপিও। এনডিএ-র পুরনো শরিক অনগ্রসর কুর্মি জনগোষ্ঠীর দল ‘আপনা দল (এস)’-এর পাশাপাশি জাতপাতের অঙ্ক মেনে মোদি-শাহরা টেনে এনেছিলেন আরও কয়েকটি দলকে। পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাঠ নেতা জয়ন্ত চৌধুরীর আরএলডি, পূর্ব উত্তর প্রদেশে মৎস্যজীবী ও মাঝি-মাল্লা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করা নিষাদ পার্টি এবং রাজভড় জনগোষ্ঠীর নেতা ওমপ্রকাশ রাজভড়ের ‘সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টি’ (এসবিএসপি) ছিল এই তালিকায়। বিজেপি ৭৫, এসবিএসপি ১ এবং বাকি দু’টি দল ২টি করে আসনে প্রার্থী দিয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা ভোটে রাজ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ে কংগ্রেস-সিপিএমের যে হাল হয়েছিল, উত্তর প্রদেশের মায়াবতীও সে ভাবে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে যাবেন বলে পূর্বাভাস ছিল বুথফেরত সমীক্ষায়। ফল বলছে, প্রায় ৯ শতাংশ ভোট পেলেও একটি আসনেও জয় পাননি মায়াবতী।

আর তাঁর দলের এই বিপর্যয়ের সুফল পেয়েছে ‘ইন্ডিয়া’। গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে রাজনাথ সিংহ (লখনউ), অখিলেশ যাদব (কনৌজ), ডিম্পল যাদব (মৈনপুরী), আফজল আনসারি (গাজিপুর), হেমা মালিনী (মথুরা), অভিনেতা অরুণ গোভিল (মিরাট) জিতেছেন। হেরেছেন বিজেপির স্মৃতি ইরানি (আমেথি), মানেকা গান্ধী (সুলতানপুর)।

উত্তর প্রদেশে চিরাচরিত জাতপাতের অঙ্কের পাশাপাশি ভোটের প্রচারে এবার মোদি জমানায় বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প, জাতগণনা এমনকি, যোগীর বুলডোজ়ার নীতি এবং জেল হেফাজতে বাহুবলী সংখ্যালঘু নেতা আতিক আহমেদ, মুখতার আনসারির মৃত্যুকেও নিশানা করেছিল বিরোধী শিবির।

এসপির যাদব-মুসলিম সমীকরণের পাশাপাশি জোট নিশানা করেছিল বিজেপির ঝুলিতে চলে যাওয়া অ-যাদব অনগ্রসর (ওবিসি) এবং অ-জাটভ দলিতদের। ৪০০ আসন নিয়ে মোদি ক্ষমতায় ফিরলে ওবিসি-দলিতদের সংরক্ষণে হাত পড়বে বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন অখিলেশরা। ‘বাঁটে তো কাটে’ স্লোগান দিয়ে ভোট ভাগাভাগি রোখার আবেদন করেছিলেন বারে বারে। অভিযোগ করেছিলেন, মায়াবতীর দল বিজেপির ‘বি টিম’-এর ভূমিকা নিয়েছে।

অন্য দিকে, হিন্দুত্বের আবেগ উস্কে দিতে গত ২২ জানুয়ারি মোদির রাম মন্দির উদ্বোধনের ছবি তুলে ধরেছিল বিজেপি। সঙ্গে ছিল জোড়া প্রতিশ্রুতি— বারাণসীর জ্ঞানবাপী এবং মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমিতে মন্দির ‘প্রতিষ্ঠা’র। অযোধ্যার মতোই ওই দুই জমি বিতর্কও এখন আদালতে বিচারাধীন।

যোগীর জমানায় ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি’ও বিজেপি নেতাদের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তাঁরা দাবি করেছিলেন, ‘মির্জাপুর’-পরিস্থিতি এখন শুধু ওয়েব সিরিজ়েই দেখা যায়! বাস্তবে নয়। এমনকি, বাংলায় ভোট প্রচারে এসেও উত্তর প্রদেশে ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের’ প্রসঙ্গ তুলে যোগী বলেছেন, ‘‘আমার রাজ্যে রামনবমীর মিছিলে হামলা হলে দোষীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতাম।’’ বস্তুত, মুলায়ম-মায়াবতীয় আমলের চেয়ে উত্তর প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে উন্নতি হয়েছে, তা বিভিন্ন জনমত সমীক্ষায়ও উঠে এসেছিল।

পক্ষান্তরে, বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রচারে বিজেপির হাতিয়ার ছিল ‘পরিবারতন্ত্র’। অখিলেশ, ডিম্পল-সহ প্রয়াত মুলায়ম সিং যাদবের পরিবারের পাঁচজনের এসপির টিকিট পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন স্বয়ং মোদি। খোঁচা দিয়েছিলেন ২০১৯-এ স্মৃতির কাছে হারার পর আমেথি ছেড়ে রায়বেরেলিতে রাহুলের ‘প্রস্থান’ নিয়েও। তাঁর দল প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর প্রার্থী না হওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল।

ভোটে জিততে মরিয়া বিজেপি বিতর্কিত নেতা এবং তাঁদের পরিবারকেও ‘অচ্ছুত’ করেনি। সাম্প্রদায়িক হিংসায় অভিযুক্ত সঞ্জীব বালিয়ান (মুজফ্‌ফরনগর) টিকিট পেয়েছিলেন। কৃষি আইন বিরোধী বিক্ষোভকারী চার কৃষককে গাড়ির চাকায় পিষে দেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত আশিস মিশ্রের পিতা অজয় টেনিকে ‘ব্রাহ্মণ ভোটের অঙ্ক’ মাথায় রেখে আবার লখিমপুর খেড়িতে প্রার্থী করা হয়েছিল। এমনকি, মহিলা কুস্তিগিরদের নিগ্রহে অভিযুক্ত কাইসারগঞ্জের সাংসদ ব্রিজভূষণ সিংহকেও বঞ্চিত করা হয়নি। সেখানে পদ্ম প্রতীক দেওয়া হয় তাঁর পুত্র করণ ভূষণকে। করণ জিতলেও বাকি দু’জন হেরেছেন।

সবশেষ খবর এবং আপডেট জানার জন্য চোখ রাখুন বাংলাদেশ গ্লোবাল ডট কম-এ। ব্রেকিং নিউজ এবং দিনের আলোচিত সংবাদ জানতে লগ ইন করুন: www.bangladeshglobal.com

সর্বশেষ খবর

আরো পড়ুন