ঢাকা      বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
শিরোনাম

পুলিশ, বিচারব্যবস্থাসহ ৫ খাতে সংস্কারের সুপারিশ জাতিসংঘের

IMG
13 February 2025, 3:53 PM

ঢাকা, বাংলাদেশ গ্লোবাল: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ও দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে এসব মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা না ঘটে সেজন্য জাতিসংঘ দেশের পাঁচটি খাতে দ্রুত ও ব্যাপক পরিসরে সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে।

যে পাঁচটি খাতে সংস্কারের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ, সেগুলো হলো- জবাবদিহি ও বিচারব্যবস্থা, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী, নাগরিক পরিসর, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সুশাসন। সংস্থাটি বলছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে সবার আগে এসব খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।

জবাবদিহি ও বিচারব্যবস্থা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনসহ এ ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য কার্যকর, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সমন্বিত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, এসব অপরাধ যাদের নির্দেশে হয়েছে, বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের ন্যায্যবিচার নিশ্চিত করা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রমাণাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজটিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে। পাশাপাশি অপরাধের প্রমাণাদি নষ্ট বা লুকানোর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা ফৌজদারি মামলা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসাথে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে, এমন কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করার সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘ বলছে, বিচারব্যবস্থায় সব পর্যায়ে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কাগজে–কলমে নয়, বাস্তবেও প্রতিফলন থাকতে হবে। বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে।

পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী

পুরো পুলিশ প্রবিধান সংশোধনের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিধি ও মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এতে সংশোধন আনতে হবে। সংশোধিত প্রবিধান অনুযায়ী গুরুতর আহত অথবা আসন্ন মৃত্যুঝুঁকি ছাড়া পুলিশ বলপ্রয়োগ এবং জনসমাগম ছত্রভঙ্গ করতে মারণাস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যবহার করতে পারবে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে ধাতব (প্রাণঘাতী) গুলি দেওয়া বন্ধের কথা বলেছে জাতিসংঘ। সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে এ ধরনের গোলাবারুদ দেওয়া কমিয়ে দিতে হবে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জড়িত ব্যক্তিদের এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে মারণাস্ত্রের ব্যবহার না করে শৃঙ্খলা ফেরানোর কৌশল শেখানো হবে।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন, পুলিশ অধ্যাদেশ সংশোধন করে নতুন আইন প্রণয়ন, মেধার ভিত্তিতে পুলিশে নিয়োগের মতো বিষয়গুলো নিয়েও বেশ কিছু সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। র‍্যাব বিলুপ্ত করে এই বাহিনীর যেসব সদস্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত নন, তাদের নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠাতে হবে। বিজিবিকে সীমান্তসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অন্য কিছুতে যুক্ত না করা এবং ডিজিএফআইয়ের কাজ সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতায় সীমাবদ্ধ রাখার সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। পাশাপাশি ডিজিএফআইয়ের আইনি ক্ষমতা কমানোর কথাও বলা হয়েছে।

স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ করে তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাগরিক প্রতিনিধিসহ নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এ কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকবে।

গণমাধ্যম-নাগরিক পরিসর

মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিতর্কিত ফৌজদারি আইনগুলো রদ অথবা সংশোধন করে এসব আইনে গ্রেপ্তার, তদন্ত ও বিচার স্থগিতের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। ঐতিহাসিকভাবে এসব আইন ব্যবহার করে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক বিরোধীদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালাতে দেখা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইন, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা–সংক্রান্ত আইন, সন্ত্রাসবাদ দমন আইন ও মানহানি আইন। এসব আইনের পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও নজরদারি–সংক্রান্ত ক্ষমতা কমানোরও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শ্রমিকনেতা, নাগরিক অধিকারকর্মীসহ অন্য মানবাধিকারকর্মীদের ওপর বেআইনি নজরদারি বন্ধে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে অবিলম্বে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলেছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা নাগরিকদের ওপর নজরদারির ঘটনায় একটি স্বাধীন তদন্ত শুরু এবং তদন্তে পাওয়া তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন আইনের অস্পষ্ট বিধিবিধান সংশোধনের কথাও বলেছে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাছবিচারহীনভাবে নজরদারির জন্য এসব বিধি যুক্ত করা হয়েছে।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা

জাতিসংঘ বলছে, মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অবাধ ও প্রকৃত নির্বাচনের জন্য একটি নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে, তাদের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। এতে করে শাসনকাজে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবের ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকবে।

কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘ। এর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে করে বাংলাদেশে বহুদলীয় গন্ত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন বাধাগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হবেন।

রাজনীতিতে ও জনপরিসরে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিতের জন্য সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিতের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

অর্থনৈতিক সুশাসন

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎসহ বড়মাপের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ জব্দ ও বাজেয়াপ্ত করার জন্য বিদ্যমান আইনে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, বিশেষ করে উচ্চ স্তরের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বিচার করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্যদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করা হয়েছে। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের শিরোনাম: ‘২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশে বিক্ষোভ সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন’।

২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ ও গুরুতর আহতসহ অনেক বিক্ষোভকারীর সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওএইচসিএইচআর।

সবশেষ খবর এবং আপডেট জানার জন্য চোখ রাখুন বাংলাদেশ গ্লোবাল ডট কম-এ। ব্রেকিং নিউজ এবং দিনের আলোচিত সংবাদ জানতে লগ ইন করুন: www.bangladeshglobal.com

এ বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ খবর

আরো পড়ুন