ঢাকা      শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
শিরোনাম

জনগণের ক্ষমতায়নে তথ্য অধিকার আইনের গুরুত্ব

IMG
01 February 2024, 12:02 PM

সানজীদা আমীন, পিআইডি, বাংলাদেশ গ্লোবাল: কাউসার আলী গত ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯এর ৮(১) ধারা অনুসারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই), মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা বরাবর রেজি: ডাকযোগে রমজান নগর ইউনিয়ন তোফাজ্জল বিদ্যাপীঠের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী , উত্তীর্ণদের ফলাফল এবং নিয়োগপ্রাপ্তদের ফলাফল সংক্রান্ত তথ্য জানতে চেয়ে আবেদন করেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট থেকে যাচিত তথ্য না পেয়ে অভিযোগকারী ২৯ডিসেম্বর২০২২ তারিখে,জেলা শিক্ষা অফিসার ও আপীল কর্তৃপক্ষ (আরটিআই),সাতক্ষীরা বরাবরে আপীল আবেদন করেন। পরবর্তীতে আপীল কর্তৃপক্ষের নিকট থেকেও কোন প্রতিকার না পেয়ে অভিযোগকারী তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন।

তথ্য কমিশন অভিযোগটি পর্যালোচনান্তে ১৫ফেব্রুয়ারি ২০২৩তারিখের সভায় শুনানীর জন্য গ্রহণ করে এবং ২৭ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ নির্ধারণ করে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে (Zoom Apps ব্যবহার করে) শুনানি গ্রহণের জন্য অভিযোগকারী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি সমন জারি করে। শুনানির ধার্য তারিখে অভিযোগকারী Zoom Apps এর মাধ্যমে সংযুক্ত হন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই)সংযুক্ত হলেও তার কোন বক্তব্য না পাওয়ায় ১৪মার্চ ২০২৩ তারিখ পুণরায় শুনানির দিন ধার্য করে অভিযোগকারী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি সমন জারি করে। শুনানির ধার্য তারিখে অভিযোগকারী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) Zoom apps এর মাধ্যমে সংযুক্ত হন। শুনানিতে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার তার বক্তব্য উল্লেখ করেন যে, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে তিনি উপস্থিত হয়েছেন।

তথ্য কমিশন উভয়পক্ষের বক্তব্য ও দাখিলকৃত প্রমাণাদি পর্যালোচনান্তে অভিযোগকারী যাচিত তথ্য সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষের নিকট সংরক্ষিত থাকায়, তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী অভিযোগকারীকে স্কুল কর্তৃপক্ষের নিকট তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন করার নির্দেশনা দিয়ে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করেন। কোন নাগরিক তথ্যপ্রাপ্তিতে বাধাগ্রস্ত হলে এবং সেক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দোষী সাব্যস্ত হলে অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর ধারা ২৫ এবং ধারা ২৭ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ ধার্যসহ জরিমানা করার বিধান রয়েছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তথ্য সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অবহেলাকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে বিভাগীয় শাস্তি প্রদানেরও বিধান রয়েছে। তথ্য অধিকার আইনে বর্ণিত কর্তৃপক্ষের নিকট হতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে এবং তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য করা হয়েছে।

তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ একটি জনবান্ধব আইন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মানুষের সকল মৌলিক অধিকারের সাথে ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ,বিবেক ও বাকস্বাধীনতার অধিকার তথা তথ্য অধিকারকে নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের সে শক্তিতে ভর করে মানবাধিকারী কর্মী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, একাডেমিশিয়ান ,সুশীল সমাজ, বেসরকারি সংস্থা সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তথ্য অধিকার বিষয় আইনের খসড়া তৈরি হয়। ২০০৮ সালে অধ্যাদেশ হয়। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন বৃহৎ দলগুলোর মধ্যে কেবল আওয়ামীলীগ তাদের নির্বাচনি ইসতেহারে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করে। ২০০৯ এর ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তথ্য অধিকার আইনটি পাস করে গেজেট প্রকাশ ও কার্যকর করে এবং কমিশন গঠন করে। সে থেকে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তাদের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আইনটি স্বীকৃতি পায়।

তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ২১ শতকে এসেও গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ মুক্তি ঘটেনি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা ,রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে তথ্য গোপন রাখার প্রবণতা এখনো প্রবল। তথ্য যারা দেবেন বা যাদের কাছে জনগণের তথ্য আছে তাদের অনেকের তথ্য গোপন রাখার সংস্কৃতি বা মানসিকতা বদলায়নি,গোপনীয়তার বেড়াজালে আটকে আছে। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ সালে পাস হলেও সরকারি গোপন আইন ,১৯২৩ দীর্ঘদিন ধরে অনুশীলনের কারণে সরকারি- বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে দাপ্তরিক গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রবণতাটি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশের তথ্য অধিকার ,২০০৯ আইনটি পাসের মাধ্যমে সব নাগরিকের তথ্য চাওয়া, পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সব তথ্যের সাবলীল প্রবেশ এবং এর প্রয়োগ উপকারভোগী হওয়ার আবশ্যিকতা ও আইনি স্বীকৃতি লাভ করেছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি ও জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়নের পথ রচিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি, দুর্নীতিহ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র বিকাশের পথ সুগম হয়েছে। আইনটিকে দ্রুত ও গতিশীল করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে উৎসাহ প্রদান করা, আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া এবং লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান করা যেতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ের জনগণকে তথ্য অধিকার বিষয়ে সচেতন করতে তথ্য অধিকার আইনের ব্যাপক প্রচার করা যেতে পারে।
তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ নিঃসন্দেহে একটি উত্তম আইন। জনগণের ক্ষমতায়নে মাইলফলক। আইনটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হল দেশের প্রচলিত অন্য সব আইনে কর্তৃপক্ষ জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে কিন্তু এ আইনে জনগণ কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষমতা আরোপ করে। এটি একটি শক্তিশালী নাগরিকবান্ধব ও সর্বজনীন আইন। শ্রেণিগত ভেদাভেদ নির্বিশেষে সর্বস্তরের নাগরিককে রাষ্ট্রের তথ্য পাওয়ার অধিকার দেয়। আইনটির মূল ভিত্তি সংবিধানের ৭ ও ৩৯ ধারা।সংবিধান মতে, জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক। প্রকৃতপক্ষে তথ্যের অধিকার ছাড়া সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত চিন্তা, বিবেক, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অকল্পনীয়।তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ এর প্রস্তাবনায় বর্ণিত এ বিষয়গুলোই আইনের মূল দর্শন। আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে।জনগণের তথ্য অধিকার তথা তথ্যে অভিগম্যতা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। এতে সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।গণতন্ত্র সুসংহত হবে। বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের সব পদক্ষেপে অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্যে অভিগম্যতার গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ‘২০৩০ এজেন্ডা’, কাউকে পেছনে ফেলে নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সমাজের সর্বক্ষেত্রে অসমতা নিরসন। বৃদ্ধ, অসহায়, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূল করে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা।বাংলাদেশে ‘তথ্য অধিকার আইন’ প্রণয়ন করে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (UDHR) এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICPPR) অনুযায়ী জনসাধারণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষা দান করেছে যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

সবশেষ খবর এবং আপডেট জানার জন্য চোখ রাখুন বাংলাদেশ গ্লোবাল ডট কম-এ। ব্রেকিং নিউজ এবং দিনের আলোচিত সংবাদ জানতে লগ ইন করুন: www.bangladeshglobal.com

এ বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ খবর

আরো পড়ুন